পার্বত্য লামা, আলীকদম এবং পার্শ্ববর্তী বমুবিলছড়ি এলাকার প্রায় ১০ হাজার একর ফসলী জমিতে চলতি মৌসুমে ক্ষতিকর তামাক চাষ করা হয়েছে। এ সকল তামাক চাষে উচ্চ ফলন ও রোগবালাই দমনের লক্ষে ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত সার ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিভিন্ন কীটনাশক। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হওয়ার পাশাপশি মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং উপকারী বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও জীববৈচিত্র বিলুপ্ত হতে চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, প্রায় ৩ যুগ ধরে চলতি বোরো ও রবি মৌসুমে লামা, আলীকদমসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে ব্যপকহারে তামাক চাষ হয়ে থাকে। অধিক ফলনের আশায় কৃষকেরা তামাকের বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে তামাক পাতা তোলার সময় পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে থাকে। জানা গেছে, খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির চেয়ে তামাকের জমিতে আট গুণ বেশি সার ও কীটনাশক ব্যবহার হয়ে থাকে। তামাকের জমিতে ব্যবহৃত সারের মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া, ফসফেট, বোরণ, দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাসিয়াম সালফেটসহ বিভিন্ন রকমের সার। এছাড়া সম্প্রতিকালে তামাকের জমিতে আগাছা না জন্মানোর জন্য ব্যবহারিত বিশেষ কীটনাশক মাটির ব্যাপক ক্ষতি করছে। মাটির উপকারী ব্যকটেরিয়াগুলো মরে গিয়ে মাটি ক্রমশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে পানির ধারন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। লামা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ নুরে আলম জানান, আগাছা দমনে ব্যবহৃত কীটনাশকের কারনে তামাক পরবর্তী ফসলে স্বাভাবিক গ্রোথ হয় না। তিনি বলেন, এ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার না করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হলেও কৃষকেরা শুধুমাত্র লেবার খরচ কমানোর জন্য কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তামাক খেতে কৃষকেরা জৈব সার ব্যবহার না করে শুধুমাত্র রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারনে জমির প্রকৃত শক্তি নষ্ট হয়ে জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলের ফলে জমিতে পলি পড়ার কারনে এখনো এ অঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিকর এ তামাক চাষ আগামী কয়েক বছর অব্যাহত থাকলে ফসলী জমিগুলো চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগের পাশাপশি কৃষকেরা তামাকের ক্ষেতে অতিরিক্ত ম্যাগনেশিয়াম, জিংক এবং অতিরিক্ত সালফার প্রয়োগ করছে। এছাড়া এম.ও পির পরিবর্তে এসওপি (সালফেট অব ফটাশ) মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করছে। এর ফলে ফসলী জমির মাটির মুখ্য এবং গৌন বিভিন্ন উপাদান নষ্ট হয়ে প্রকৃত শক্তি হারাচ্ছে।
এদিকে, তামাক চাষের জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কীটনাশকের বেশির ভাগই কৃষকেরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে জমিতে স্প্রে করে থাকে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্প্রে ম্যানকে কীটনাশক প্রয়োগের সময় নোজ, মাস্ক, ফেইস মাস্ক, চশমা, ও ক্যাপ ব্যবহার করা এবং শরীরে মোটা কাপড় পরিধান করা উচিত হলেও তা এখানে করা হচ্ছে না। বরং অনেকে অনাবৃত শরীরে আবার কোথাও কোথাও শিশুরা পর্যন্ত অসচেতনভাবে কীটনাশক স্প্রে করছে। এর ফলে অপরিকল্পিতভাবে কীটনাশক স্প্রে করার কারণে এসকল কীটনাশক কৃষকের শ্বাস–প্রশাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে কৃষকেরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ মোঃ শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, এভাবে স্প্রের কারণে শ্বাস প্রশাসেরর সাহায্যে কীট নাশক মানব দেহে প্রবেশ করলে তার ক্ষুধা মন্দা, চোখের ক্ষতি, এবং শ্বাস–কষ্ট, বমি বমি ভাব হতে পারে। এছাড়া এর ফলে যক্ষ্মা এবং ফুসফুস ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবাবনাও রয়েছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ফলে শুধুমাত্র মানুূষ ও মাটির ক্ষতি হচ্ছে না। পাশাপাশি পশু, পাখি ও জলাশয়ের মৎস্য সম্পদও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জানা যায়, ব্যাপক তামাক চাষের কারণে বর্তমানে এলাকায় গো খাদ্যের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জমিগুলোতে প্রয়োগকৃত মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের পুরাটাই মাটি অল্প সময়ে গ্রহণ করতে পারে না। এছাড়া উৎপাদিত তামাকের মূল গাছ এবং এর আংশিক পাতাসহ কৃষকেরা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে বিষাক্ত কীটনাশক মিশ্রিত জমির এসকল ঘাস খেয়ে গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদি পশু পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া তামাক খেতে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ মতাক্ষসম্পন্ন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ, পশু পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে। তামাকের জমিগুলোতে অতিরিক্ত বিষ প্রয়োগের ফলে শস্য পরাগায়নকর্মী হিসেবে খ্যাত প্রজাপতির বংশধর, মৌমাছি, ঘাস ফড়িং, ব্যাঙ ও কেঁচোরমত হাজার উপকারী প্রাণী এতদাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হতে চলছে। অপরদিকে তামাক চাষে অতিমাত্রায় সার, বিষ, বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক, ছত্রাক নাশক ও আগাছা নাশক ব্যবহারের ফলে বর্ষা মৌসুমে তামাকের জমির বর্জ্য বৃষ্টিতে ধুয়ে পার্শ্ববর্তী মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে পড়ে নদীর পানি বিষাক্ত হচ্ছে। এর ফলে নদীর পানি ব্যবহারকারী এবং নদীতে গোসলকারী স্থানীয় বাসিন্ধারা চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বৃষ্টির পানির সাথে তামাক ক্ষেতের প্রয়োগকৃত বিষাক্ত কীটনাশক নদীর পানিতে মিশ্রিত হওয়ার কারণে নদীর মাছ কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে মাতামুহুরীর বিভিন্ন ছোট জাতের মিঠাপানির মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নুরে আলম জানান, বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব ও পরিবেশ বান্ধব সরকার। সরকার রাসায়নিক সার প্রয়োগ কমিয়ে জৈব সার প্রয়ৈাগ করে চাষাবাদের জন্য কৃষি বিভাগের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। আমরা সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সেমিনারের মাধ্যমে কৃষকদেরকে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি।
লামা ও আলীকদমের আবাদী ফসলী জমিগুলোতে ক্ষতিকর তামাক চাষে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কীটনাশক স্প্রে করণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর হস্তক্ষেপ দরকার বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।
পাঠকের মতামত: